চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ
ভূমিকা: সমাজব্যবস্থার শুরু থেকেই মানুষ তার জীবনকে সুখী-সমৃদ্ধ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। মানুষের অব্যাহত প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানবসভ্যতা আজ উৎকর্ষের চরম শিখরে পৌছতে সক্ষম হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একের পর এক বিপ্লব মানবসভ্যতাকে একটি স্তর থেকে অন্য স্তরে উন্নীত করেছে। এ পর্যন্ত বিশ্ব তিনটি শিল্পবিপ্লব অবলোকন করতে পেরেছে। সভ্যতার ইতিহাসে প্রতিটি বিপ্লব অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের পর বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে ক্রমশ ধাবমান। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে নানা আলোচনা, গবেষণা ও জল্পনা-কল্পনা ৷
শিল্পবিপ্লব: শিল্পবিপ্লব হচ্ছে উৎপাদনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন। এর মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ উন্মোচিত হয়। ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়। প্রথম শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে ইংল্যান্ড তথা সমগ্র বিশ্বে উৎপাদনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মূলত ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী এ বিপ্লব কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক বাণিজ্যিক ব্যবস্থা থেকে আধুনিক শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের পরিধি ছিল প্রথম বিপ্লবের তুলনায় ব্যাপক। ১৮৭০ সালে বিদ্যুতের আবিষ্কার শিল্প উৎপাদনে এক নতুন গতির সঞ্চার করে। ফলে উৎপাদনব্যবস্থায় শিল্পকারখানাগুলো তড়িৎ ও অ্যাসেম্বলি লাইনের মাধ্যমে ব্যাপক উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করে।
দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের ব্যাপ্তি ছিল উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। মানবসভ্যতার ইতিহাসে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সূচনা ঘটে ১৯৬০ এর দশকে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবকে কম্পিউটার বিপ্লবও বলা হয়। সেমিকন্ডাক্টর, মেইনফ্রেম কম্পিউটার ও ইন্টারনেট এ বিপ্লবের ধারক ও বাহক। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কার তৃতীয় শিল্পবিপ্লবকে চূড়ান্ত গতি দান করে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লব বিশ্বকে একটি গ্রামে পরিণত করেছে। ফলে উৎপাদনব্যবস্থায় অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়। তবে এ তিন বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: সময় এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের। এ শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি হলো প্রযুক্তি। ক্ষুদ্র ও শক্তিশালী সত্তা সেন্সর, মোবাইল ইন্টারনেট, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা মেশিন লার্নিং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভরশক্তি। এ বিপ্লবে মেশিনকে বুদ্ধিমান করে তৈরি করা হচ্ছে। মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং, রোবটিক্স, অটোমেশন, ইন্টারনেট অব থিংস, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, জিন প্রযুক্তি ও প্রকৌশল ইত্যাদির সমন্বয়ে আজকের বিশ্বে আমরা যে পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। অনেকে এটাকে ডিজিটাল বিপ্লব কিংবা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। World Economic Forum (WEF)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান ক্লাউস শোয়াব তার 'The Fourth Industrial Revolution' গ্রন্থে বলেন, “আমরা চাই বা না-চাই বিশ্ব ক্রমশ পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে চলছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসাবাণিজ্য, যোগাযোগ নিরাপত্তা, গবেষণা সবক্ষেত্রেই চতুর্থ বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে।”
শোয়াব ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগাম ফসল হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ১০ শতাংশ মানুষের পরিধেয় বস্ত্রের সাথে সংযুক্ত থাকবে ইন্টারনেট, ১০ শতাংশ মানুষের চশমার সাথেও ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকবে, পাওয়া যাবে মানুষের শরীরে স্থাপনযোগ্য মোবাইল ফোন, ৯০ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করবে, আমেরিকায় ১০% গাড়ি হবে চালকবিহীন, ৩০ শতাংশ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অডিট হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অডিটর দিয়ে, এমনকি কোম্পানির বোর্ডের একজন পরিচালক হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বদলে দিতে যাচ্ছে সারাবিশ্বের মানুষের জীবনযাপন প্রণালি। সারাবিশ্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে প্রচুর আলোচনা এবং গবেষণা হচ্ছে। আজ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকেও প্রস্তুতি নিতে হবে। ভবিষ্যতের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্যে এবং ভবিষ্যৎ বিশ্বের একটি উন্নত ও অগ্রগামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ার ক্ষেত্রে বহুমুখী সম্ভাবনার ক্ষেত্র যেমন অবারিত-উন্মুক্ত, ঠিক তেমনি এ চ্যালেঞ্জের সমস্যার দিকগুলোকেও বিবেচনায় নিতে হবে।
সম্ভাবনা: চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা ভোগ করতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষায় বাংলাদেশ যত এগিয়ে যাবে, বাংলাদেশের অগ্রগতি তত ত্বরান্বিত হবে। এ শিল্পবিপ্লবের সময়কালে রোবটিক্স, ক্লাউড টেকনোলজি, ব্লকচেইন, থ্রিডি প্রিন্টিং, ন্যানোটেকনোলজি এবং বায়োটেকনোলজি প্রভৃতি বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্ব পাবে। তাই বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলে এ তরুণ সমাজকে মানবমূলধনে রূপান্তর করতে হবে।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে চাকরিমুখী না করে ডিজিটাল প্রযুক্তিগত শিক্ষার মাধ্যমে উদ্যোক্তামুখী করার কর্মকৌশল ও পরিবেশ সৃষ্টি করে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মডেল হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। দেশের বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এরই মধ্যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করেছেসরকার। বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের সুযোগসুবিধাও। এরই মধ্যে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে জাপান, চীন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ নানা ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে তুলেছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি বিশ্বের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ায়ও আনবে ব্যাপক। পরিবর্তন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ অনেক কমে যাবে। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে। বাংলাদেশও এর সুফল ভোগ করবে।
এ বিপ্লবের সুফল পেতে বাংলাদেশ সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ১২ ডিসেম্বর ২০০৮ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের এ নতুন বিপ্লবে শামিল হওয়ার সুযোগ করে দেন। তিনি ২০১০ সালে সারাদেশে একযোগে ৪,৫০১টি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করেন।
ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এখন সহজে যুক্ত হতে পারছে জ্ঞানের মহাসড়কে। এর পাশাপাশি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে ক্রমান্বয়ে রোবটিক্স, বিগ ডাটা অ্যানালিটিক্স কিংবা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেজন্য সরকার ১২৯টি বিশেষায়িত ল্যাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে ।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার জন্য সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৮টি হাইটেক ও সফটওয়্যার পার্ক তৈরি করেছে। এ বিপ্লবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে দেশে প্রথম বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ১২ মে ২০১৮ মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের উৎপাদনব্যবস্থায় গতি সঞ্চার হবে। শিল্পকারখানায় রোবট ও অটোমেশন প্রযুক্তি কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকি হ্রাস করবে। জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওষুধ তৈরির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের চাহিদা সৃষ্টি হবে। অস্ত্রোপচারে প্রযুক্তির ব্যবহার চিকিৎসাসেবাকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করবে। ব্যাংক খাতে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ তথা সকল শ্রেণির মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা যাবে। ফলে অনলাইনে লেনদেন বৃদ্ধি পাবে ।
সমস্যা: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যেমন একদিকে বাংলাদেশে সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে তেমনি এটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে শুরু করবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে একদিকে যেমন নতুন কর্মসংস্থান হবে তেমনি অন্য মানুষের চাকরি হারানোর সম্ভাবনাও তৈরি হবে। স্মার্ট যন্ত্র বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতে । প্রায় ৬০ লাখ লোক কাজ করে এ খাতে। রোবট ও স্মার্ট যন্ত্রের ব্যবহারে শ্রমের ওপর নির্ভরতা কমে যাবে। অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। শুধু গার্মেন্টস নয়, আরও অনেক পেশা; যেমন: হিসাবরক্ষক, আইন পরামর্শক, পরীক্ষক, রেস্টুরেন্টে সেবা প্রদানকারী, ক্যাশিয়ার ইত্যাদি পেশায় মানুষের ভূমিকা অনেকটাই কমে যাবে। । চালকবিহীন গাড়ি চালু হলে চালক অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়াবে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিশ্বব্যাপী অসাম্য ও দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরো প্রকট করে তুলবে। তাই বলা যায়, এ বিপ্লব বাংলাদেশেও অসাম্য ও দারিদ্র্যকে প্রকট করে তুলবে।
এ বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের তরুণ সমাজকে দক্ষ করতে না পারলে এবং দেশের প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে প্রত্যেকটি সেক্টরে ধস নামতে পারে।
এছাড়াও এ বিপ্লবের সবচেয়ে বড় হুমকি হলো ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার অভাব। ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত না করা গেলে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট হবে। ফলে মানুষ নানা ধরনের বিড়ম্বনা বা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনায় সমগ্র জাতিই ক্ষতিগস্ত হতে পারে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব হবে ব্যাপক। ব্যতিক্রমী পণ্যসেবার পাশাপাশি নিয়ত পরিবর্তনশীল গ্রাহক চাহিদা পূরণে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি ব্যবহারে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সরকারের দেশ পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণেও ডিজিটাল বিপ্লব আনবে বড় পরিবর্তন। প্রযুক্তিবিপ্লব সরকারি সেবাকে একদিকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসবে। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তিতে চরম উৎকর্ষ লাভকারী যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্বে যে নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবই যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করবে, সেই আশঙ্কাও করছেন বিশ্লেষকেরা।
0 Comments