ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি বিষয়ে একটি রচনা লিখুন। Write an essay on Blue Economy.

ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি

ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি বিষয়ে একটি রচনা লিখুন।
ভূমিকা: বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক সমুদ্র বিজয় অর্জন করেছে। দেশের দক্ষিণে জলসীমা সংলগ্ন সমুদ্রের বুকে আমাদের ভূখণ্ডের প্রায় সমপরিমাণ এলাকায় সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা জাতির জন্য আরেকটি সুবিশাল অর্জন। এমন যুগান্তকারী অর্জন জাতির জন্য নিশ্চিতভাবেই সম্মান ও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে ।

বাংলাদেশের সমুদ্র অধিকার: ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পরপরই দীর্ঘ ৩৮ বছর ঝুলে থাকা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় প্রচেষ্টা শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রীর সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে সব মিলিয়ে প্রায় ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র সীমার ওপর বাংলাদেশের একচ্ছত্র মালিকানা, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ।

সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ইতিবৃত্ত: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪। সালে সমুদ্র বিজয় অভিযাত্রার সূচনা করেন। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় তিনি বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৩নং অনুচ্ছেদের (২) নং ধারা অনুযায়ী সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোন্স অ্যাক্ট১৯৭৪ প্রণয়ন করেন, যা গেজেট হিসেবে প্রকাশ পায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪। তখন বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক সমুদ্রবিষয়ক আইন পাশ হওয়ার পরপরই মিয়ানমারের সঙ্গে সেন্টমার্টিনে ১২ মাইল ‘টেরিটোরিয়াল সি' ঠিক করে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে দীর্ঘদিন দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট সমুদ্রসীমার বিষয়টি অবহেলিতই থেকে যায়। তবে ১৯৭৪ সালে প্রণীত আইনটিই আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। যার প্রতিফলন দেখা যায় ৮ বছর পর ১৯৮২ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক সমুদ্র আইন বিষয়ক কনভেনশনে। পরবর্তীকালে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৮২ সালের ইউনাইটেড নেশনস কনভারসেশন অন দি ল অব দি সি আইনটি অনুসমর্থন করে। ফলে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে ৩৫০ মাইলব্যাপী মহীসোপানের দাবি জাতিসংঘে উত্থাপনের দায় সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে দীর্ঘ ৩৮ বছর ঝুলে থাকা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার সময়োপযোগী এক সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং সফলভাবে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়।

ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি: সমুদ্র হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। সমুদ্র মৎস্য সম্পদের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করে, যাত্রী ও মালামাল পরিবহণের একটি দক্ষ মাধ্যম হিসেবেও সমুদ্র ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া সমুদ্র নানা ধরনের প্রাকৃতিক খনিজসম্পদ যেমন লবণ, বালি, গ্রাভেল, কপার ও কাল্ট ইত্যাদির আধার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং তেল ও গ্যাসসম্পদ আহরণের ক্ষেত্র হিসেবেও সমুদ্র ব্যবহৃত হয়। এসকল উপাদানের সমষ্টিই হলো সুনীল অর্থনীতি (Blue Economy)। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করা, সামাজিক পুঁজির সৃষ্টি করা, আয় বাড়ানো এবং সর্বোপরি পরিবেশের সাথে সঞ্চয়-বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা। কাজেই এ ধরনের সমুদ্রনির্ভর উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চিত্রকে পাল্টে দিতে পারে । সমুদ্র আমাদের পৃথিবীর প্রায় ৭২% এবং বায়োস্ফেয়ারের প্রায় ৯৫% এলাকা ঘিরে রয়েছে। অক্সিজেন সরবরাহ করা, কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করা, পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করা ইত্যাদি নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদ আমাদের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলতে সহায়তা করে। পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষের খাবার এবং জীবনযাত্রা সমুদ্রের ওপর নির্ভর করে এবং বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৮০% সমুদ্র পরিবহণের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। বৈশ্বিক পর্যটন শিল্প এবং প্রকৃতিনির্ভর পর্যটন শিল্পের বিকাশে সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় পরিবেশ ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পালন করে। 

উপরন্তু বিশ্বে মোট হাইড্রোকার্বনের ৩২% সরবরাহ হয় সামুদ্রিক উৎস থেকে। নতুন নতুন উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আহরিত খনিজ সম্পদ থেকে বায়োপ্রোসপেকটিং সরবরাহের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে সমুদ্র। রিও+২০ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের সামুদ্রিক এলাকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং এর সামগ্রিক উন্নয়নে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সমুদ্রের সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা অপরিহার্য। 

বর্তমান পৃথিবীর একটি অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, অনিশ্চিত অর্থনৈতিক অবস্থা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রমাগত প্রতিযোগিতার মুখে ২০৫০ সালের মধ্যে ৯ বিলিয়ন মানুষের আহার জোগাড় করা। এই সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে সমুদ্র সম্পদ এক বিরাট ভূমিকা রাখে। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৫ এর মিলেনিয়াম ডেভেলপয়েন্ট গোল পরবর্তী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা SDGs নির্ধারণে সুনীল অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ব্লু-ইকোনমি কার্যক্রম বাস্তবায়নে যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন: বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতির কার্যক্রম বাস্তবায়নে বর্তমানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় নানা ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বিশেষ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে 'ব্লু-ইকোনমি সেল' গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু সুনীল অর্থনীতির কার্যক্রমসমূহ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল এবং মহীসোপান প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। সে কথা বিবেচনা করে এবং রূপকল্প ২০৪১ সামনে রেখে বঙ্গোপসাগরের সম্পদ অনুসন্ধান, আহরণ এবং তার সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনীল অর্থনীতির ওপর জোর দিয়েছেন । আমরা যদি টেকসই উন্নয়নকে বিবেচনায় রেখে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই, তাহলে সুনীল অর্থনীতিকে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। এ বিবেচনায় নিচে বর্ণিত কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে:

i. সামুদ্রিক এলাকা হতে প্রাপ্ত প্রধান অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— তেল ও গ্যাস, মৎস্য সম্পদ, ঢেউয়ের শক্তি, জোয়ারের শক্তি, উপকূলীয় বায়ু, লবণের উৎপাদন, সামুদ্রিক তাপ-শক্তি রূপান্তর, সামুদ্রিক খনিজ আহরণ " ইত্যাদি। এ সব সম্পদ আহরণ এবং ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে, বাংলাদেশকে অবশ্যই সমুদ্র অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন (ব্লক), ম্যাপিং এবং আহরণযোগ্য সম্পদের পরিমাণ অ্যাসেসমেন্ট করা অত্যন্ত জরুরি।

ii. সুনীল অর্থনীতি যেহেতু পৃথিবীব্যাপী একটি নতুন ধারণা, সেই বিবেচনায় এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা, জ্ঞান অন্বেষণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা যেতে পারে।

iii. এক সময়ে মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটার খুবই প্রচলন ছিল। বর্তমানে পুষ্টির উৎস হিসেবে প্রাণিসম্পদ নির্ভরতার দিকে গুরুত্ব ... দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রাণিজ খামার ব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাণির জাত উদ্ভাবন করা খুবই দুরূহ। সেই বিবেচনায় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণ ও তার ব্যবহারের মাধ্যমে অতীতের মাছে-ভাতে বাঙালি ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

iv. সমুদ্র ও সমুদ্রবিজ্ঞান তথা মেরিটাইম খাতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সুনীল অর্থনীতির ওপর গুরুত্বারোপের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে মেরিন স্পেসে নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিশেষ করে মেরিকালচার, সমুদ্র পরিবহণ, পর্যটন, মৎস্য সম্পদ আহরণ ইত্যাদির মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে মেরিন বায়োটেকনোলজি গবেষণায় গুরুত্বারোপ করা হলে অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্টার্ন ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ সমুদ্রজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে। সমুদ্রে খাঁচায় মাছ চাষ জনপ্রিয় করা যেতে পারে । এছাড়াও ভেটকি হ্যাচারি স্থাপন করার মাধ্যমে ভেটকি মাছ চাষ জনপ্রিয় করা যেতে পারে। বিশেষ করে খাঁচায় ক্র্যাব ফ্যাটেনিং ভালো একটি উদ্যোগ হতে পারে। বাংলাদেশে টুনা ফিশারির জন্য কুল চেইন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে, সেই কুল চেইনে শুধু ইন্ডিয়ান টুনা সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ করা হয় । জানা যায়, বু ফিন টুনা কিংবা ইয়েলো ফিন টুনা মাছ ধরার কোনো প্রযুক্তি আমাদের দেশে নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের টুনা মাছ চিহ্নিত করাসহ মাছ ধরার প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেতে পারে।

v. সিউইড (Seaweed) খুবই স্বাস্থ্যসম্মত একটি খাবার। যদিও সিউইড জনপ্রিয় খাবার হিসেবে বাংলাদেশে প্রচলিত নয়, কিন্ত উন্নত দেশগুলোতে সিউইড খুবই জনপ্রিয়। সিউইড রফতানির জন্য গুণগত মান বজায় রাখার লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীন ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামে কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে।

vi. সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (ppp) পদ্ধতিতে গভীর সমুদ্রে মাছের মজুদ চিহ্নিত করতে পারে। টেকসই উপায়ে মাছ ধরা নিশ্চিত করতে মাছের মজুদ চিহ্নিতকরণ খুবই জরুরি।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অর্জিত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি সোপান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। উল্লিখিত প্রস্তাবনা বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে ২০৪১ সালের মধ্যে সুনীল অর্থনীতি উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণে অনন্য অবদান রাখবে। বলে আশা করা যায় ।

Post a Comment

0 Comments